
একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিএনপি নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া সুনিশ্চিত মনে করেছিলো। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন, আশা ও ভরসা এখন অনেকখানিই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইউনুস সরকারের অসহযোগিতায় এবার সংকটে পড়েছে বিএনপি।
সংকটের প্রধান কারণ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে বিএনপি-র সম্পর্কে ফাটলঃ গত প্রায় আট মাসে বাংলাদেশের তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে বিএনপি-র সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটি আরো স্পষ্ট হয়েছে ১৬ এপ্রিল ২০২৫ বুধবার অনুষ্ঠিত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে বিএনপি-র এক বৈঠকের পর। পুর্ব নির্ধারিত এই বৈঠক থেকে দলটি নির্বাচনসহ তাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে ইউনুস সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার আশা করেছিলো। কিন্তু বৈঠকের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কোনো সময় না-দেয়ায় তারা একেবারেই সন্তুষ্ট নন।
এছাড়া বৈঠকে মির্জা ফখরুল ইসলাম দল বা গোষ্ঠীস্বার্থে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে হেয় ও অপ্রাসঙ্গিক করার অপচেষ্টায় সময়ক্ষেপণ করে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কৌশল বিএনপি সমর্থন করে না বলে ইউনুস সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে। সে কারণে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ শিগগির ঘোষণার মাধ্যমে জনমনে সৃষ্ট সব বিভ্রান্তি অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এসময় মির্জা ফকরুল ইউনুস সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনপিসি-র নেতাদের বক্তব্য ও কার্যকলাপের সমালোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। তিনি বলেছেন, তারা সংস্কারের কথা বেশি বেশি বলে বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করছেন। তাদের ভিশন-২০৩০ এবং রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচিতে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে ও যেসব পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার সবই সংস্কার নয়। সংস্কারের উদ্দেশ্য হতে হবে ইতিবাচক ও গঠনমূলক।
বিএনপি-র এই বক্তব্য এবং অসন্তোষের বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে তো নেইই নি, বরং উল্টো প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে। বৈঠকের পর বিএনপি নেতাদের "আনন্দিত মনে হয়েছে" বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।তিনি আরো বলেছেন যে “ওনাদের মনে যে প্রশ্ন ছিল সেগুলোর উত্তর তারা পেয়েছেন। আমার কাছে তা মনে হয়েছে, ফখরুল ভাইয়ের কাছে অন্যরকম মনে হতে পারে।”
জামাতের বৈরিতাঃ জামাত এক সময় বিএনপি-র প্রধান সহযোগী ছিলো। সেই জামাতও এখন অনেক দূরে। বিএনপি-কে ছেড়ে এই চরম ডানদল নতুন গজে ওঠা এনপিসি-র হাত ধরেছে।কারণ এনপিসি জামাতেরই বিটিম। ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার কৌশল হিসেবে ইউনুসকেও জামাত অকুন্ঠ সমর্থন দিচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচন প্রশ্নে জামাত বিএনপি-র বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি যখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করেছ, তখন জামাত বলেছে তারা আগামী বছরের প্রথমদিকে নির্বাচন হলেই খুশি। দলটির নেতারা এপ্রিলের মাঝামাঝি লন্ডনে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করার প্রেক্ষিতে বিএনপি-র সঙ্গে পুনঃমিলনের একটা ধারণা হয়েছিলো। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে ভিন্ন অবস্থান সেই ধারনা ভুলই প্রমাণ করে।
বিএনপি-র বিরুদ্ধে এনপিসি-র অভিযোগঃ এনসিপি-র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন যে দেশের অনেক জায়গায় বিএনপি প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ফেলেছ। এ অবস্থায় কোনো ধরনের পরিবর্তন বা মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, সেই নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশ নেবে কি না সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
প্রগতিশীলদের সাথে দূরত্বঃ বিএনপির মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের উভয় শক্তিই রয়েছে। অবশ্য বর্তমান নেতৃত্ব স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরই হাতে। তবু এই দল স্বাধীনতার পক্ষের এবং প্রগতিশীল দলগুলোর সাথে দূরত্ব রেখে চলেছে। এর কারণ দলটির মূল নেতৃত্ব সেন্টার-রাইট অবস্থানে থাকায় তারা ডানপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে বৃহত্তর জোট গড়ে তুলতে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
এই পরিস্থিতিতে আশু নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপি এখন দৃশ্যতঃ একা। আওয়ামী লীগের মাঠে নামার কোনো সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমার্থক এই দলের অস্তিত্ব নির্মূল করার প্রাণপণ অভিযানে ইউনুস ও তার প্রশাসন দিনরাত ব্যস্ত। প্রকাশ্যে এই দলের নাম নিলেও তার জানমালের নিরাপত্তা কেউই দিতে পারছে না। আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতা বিরোধীরাই এখন সামনের সারিতে।
নতুন সংকটে বিএনপি-দলে হতাশাঃ
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি এক নতুন সংকটের মধ্যে পড়েছে।বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় এমন ধারণা দলটি জনসাধারণকে দিতে পারছে না।ফলে দলীয় কর্মীদের মধ্যে হতাশা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যা আরো গভীর হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর ইউনুসের সঙ্গে বিএনপি-এর নেতৃবৃন্দ সাম্প্রতিক এক বৈঠকের পর।এই অবস্থায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শন ও দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের কথা বার বার বললেও বাস্তবে বিএনপি সে ধরনের কোন আন্দোলন আজ পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারে নি। অদুর ভবিশ্যতে পারবে এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
কাজেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, বিএনপি যে ক্ষমতায় যাওয়ার যে আশা করেছিলো, সে আশা পুরনের পথে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে দলটি। প্রশ্ন হচ্ছে এই চ্যলেঞ্জ কি বিএনপি একা মোকাবিলা করতে পারবে?