Blog
April 11, 2025

নিজের ভবিষ্যত গড়তে ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ যেভাবে কাজে লাগিয়ে ছিলেন ইউনুস

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস সুবক্তা হিসেবে খ্যাতিমান। তিনি শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে নিজের স্বার্থে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম। সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এ আবারও এর প্রমাণ রাখলেন।

এই সম্মেলনে একটি আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করেন। নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন তিনি গরীবদের দুর্দশায় সবসময় গভীরভাবে ব্যথিত। তিনি আরো দাবি করেন যে ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাই মূলতঃ তাকে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেছিল।

এই বর্ণনায় কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য বাদ দেওয়ায় ইউনুস সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তিনি উল্লেখ করেননি যে তার ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পটি ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একটি উদ্যোগ হিসেবে জোবরা গ্রামে শুরু হয়েছিল। সরকারি সহায়তায় ১৯৮২ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা বা কলাম্বিয়া ব্যাংক অব মাইক্রোক্রেডিটের নীতিমালা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার সময়ে কলাম্বিয়ার কিছু শিক্ষার্থীদের প্রভাবের কথাও তিনি উল্লেখ করেননি। 

২০০৬ সালে ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। যদিও ইউনুসকে 'ক্ষুদ্রঋণের গুরু' হিসেবে ব্যাপকভাবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, এই ধারণার উৎপত্তি ১৯৫০-এর দশকে যখন আখতার হামিদ খান পূর্ব পাকিস্তানে এটি চালু করেছিলেন। ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে এই মডেলটিকে জনপ্রিয় ও পরিমার্জিত করেছেন। 

গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীদের ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকার জন্য সুপরিচিত। তবে উচ্চ সুদের হার এবং ঋণ আদায়ে কঠোর পদ্ধতির জন্য এটি সমালোচিতও হয়েছে।অভিযোগ ছিলো যে ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণের জন্য ৪৪% পর্যন্ত সুদের হার ধার্য করে গরীবদের শোষণ করছেন। তিনি এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করলেও ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো ডেভিড রুডম্যান ২০১০ সালে একটি বিশ্লেষণ করেছিলেন যাতে দেখা যায় যে ইউনুসের সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যকর সুদের হার ছিল ২০% থেকে ২৫%। তদুপরি যেসব ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পেতে একটি বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ী হিসাব বজায় রাখতে হতো, তাদের ক্ষেত্রে এই হার বেড়ে ৪৪% হয়েছিল। উচ্চহারের ঋণ শোধ করতে না-পারার ব্যর্থতায় অনেক ঋণগ্রহীতা আত্মহত্যা করেছেন বলেও একসময় সংবাদ মাধ্যমে অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।

ইনভেস্টমেন্ট সামিটে ভাষণে ইউনুস দুর্ভিক্ষের প্রভাব সম্পর্কে কথা বললেও এর কারণ সম্পর্কে খুব সীমিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এর মূল কারণগুলোর গভীরে গিয়ে একটি বিশ্লেষণ দিলে তা উপকারী হতে পারত, যা প্রাসঙ্গিক তথ্য ও স্বচ্ছতা দিত এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে জনসাধারণের অনুমান ও ভুল বোঝাবুঝি কমাতে সহায়তা করত। 

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যার পেছনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক কার্যকারণ সম্পৃক্ত ছিলো। এসবের মধ্যে বন্যা ছিল প্রধান। এই বন্যা কৃষিখাতকে ধ্বংস করার পাশাপাশি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাপক বেকারত্ব সৃষ্টি করেছিল।নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন তার এক নিবন্ধে এই সমস্যাগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যা আমাদের এই ধরনের সংকট বুঝতে সহায়তা করে। 

"দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল বন্যায় সৃষ্ট আঞ্চলিক বেকারত্বের মাধ্যমে। এই বন্যা খাদ্য উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছিল কয়েক মাস পরে, যখন ক্ষতিগ্রস্ত ফসল কাটা হয়েছিল। তবে দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল তার আগেই, ক্ষতিগ্রস্ত ফসল পাকার পূর্বেই।" 

এই সমস্যা আরও গভীর করেছিল বৈশ্বিক খাদ্য সংকট, যা ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক শস্য ক্রয়ের ফলে সৃষ্ট হয়েছিল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০২১ সালে প্রকাশিত হাভিয়ের ব্লাস ও জ্যাক ফারচির গ্রন্থ "The World for Sale"-এ এর বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে যে, ভয়াবহ ফলন হ্রাসের মুখে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১০ মিলিয়ন টন শস্য ক্রয় করেছিল- যাকে "গ্রেট গ্রেইন রবারি" বলা হয়। এই ঘটনা বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং সারা বিশ্বে শস্যের দাম বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

এই বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ছাড়াও, নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার দুর্বল অবকাঠামো, অদক্ষ খাদ্য বিতরণ ও প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারি নি।প্রতিবেশী দেশগুলোতে খাদ্যশস্য পাচারও দেশীয় সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

বক্তৃতায় ইউনুস স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। তবে তিনি গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ করেননি- যে সাফল্য জেনেভাভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) সহ বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে।